স্টেডিয়ামের মূল ফটকের কাছে তখন ছোট্ট এক জটলা— যেন বিক্ষুব্ধ জনতার শেষ আশ্রয়। বাতাসে ফুটবলের রোমাঞ্চের গন্ধ, কিন্তু তার সঙ্গে মিশে আছে একরাশ ক্ষোভ, একচিলতে হতাশা। কয়েকজন তরুণ একসঙ্গে চিৎকার করছে, কেউ ধাক্কা দিচ্ছে, কেউ ঘুষি মারছে, কেউবা চোখের জল লুকোচ্ছে অন্ধকারে।
এরা কেউ একে অপরের শত্রু নয়— সবাই একই পতাকার প্রেমে ডুবে থাকা মানুষ। কিন্তু যাদের ওপর রাগ ঝরছে, তাদের নাম ফাহিম ও সাদ।
একজন গোল খাইয়েছেন, আরেকজন গোল উপহার দিয়েছেন হংকংকে। মাঠের ব্যর্থতা এসে থেমেছে গ্যালারির গলিতে, বন্ধুত্বের বুকেও ঢুকেছে হতাশার ছুরি।
স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে কিছু ভক্ত চিৎকার করছে, “ভুয়া! ভুয়া!” তাদের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু — বাংলাদেশ দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরা। তাদের কণ্ঠে একটাই সুর: “এই কোচ যতদিন থাকবে, আমরা মাঠে আসব না!”
কিন্তু প্রশ্ন হলো — সত্যিই কি তারা আর আসবেন না? যদি না-ও আসেন, তাহলে কি আবারও ফুটবল ডুবে যাবে হতাশার অতলে?
এক বছর আগেও দৃশ্যটা ছিল একেবারেই ভিন্ন। তখন বাংলাদেশের ফুটবল নব্বই দশকের হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধছিল। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মাঠে জন্ম নেওয়া হামজা চৌধুরী যখন ঘোষণা দেন, “আমি বাংলাদেশ।” তখন গোটা জাতির হৃদয়ে ঢেউ উঠেছিল। এরপর কানাডা প্রবাসী শমিত সোমও লাল-সবুজের পতাকা কাঁধে নেন। জনতার মাঝে ফুটবল আবার বেঁচে ওঠে— গলির চায়ের দোকান থেকে সোশ্যাল মিডিয়া পর্যন্ত আলোচনার ঝড়।
এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচটা ছিল উৎসবের মতো। গ্যালারি পূর্ণ, বাইরে আরও দ্বিগুণ জনতা। মানুষের মুখে শুধু একটাই শব্দ — “বাংলাদেশ!” কিন্তু আবেগে জেতা যায় না ম্যাচ। বিতর্কিত রেফারিং, অদ্ভুত কৌশল, আর ভুল একাদশ— সব মিলিয়ে হারল বাংলাদেশ। তবে সেদিন থেকেই শুরু কাবরেরার কৌশলগত ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’র পর্ব— যার ফলাফল আজও তিক্ত।
হংকং ম্যাচে আবারও সেই সাদ উদ্দিন। যিনি এর আগেও নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সেশেলসের বিপক্ষে একই ভুলে স্বপ্ন ভেঙেছেন। মাঠের বাইরে বসে ছিলেন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ জায়ান আহমেদ। শেষ দিকে যখন তাকে মাঠে নামানো হলো, দুই গোলে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ সমতায় ফেরে। গ্যালারি জেগে ওঠে নতুন আশায়। কিন্তু সেই আশায় ছায়া ফেলে আবারও সাদের ভুল —একটি বিপর্যয়কর পাস, মার্কিসের গোলে জয় হংকংয়ের। দূরে বসে এক সমর্থক নিঃশব্দে বলেন, “হংকং নয়, গোলটা আসলে মেরেছেন কাবরেরাই।”
যেখানে সিঙ্গাপুর ম্যাচে শমিত সোম ছিলেন সেরা, সেই শমিতকেই বেঞ্চে রেখে খেলানো হয় সোহেল রানাকে— যিনি প্রতিপক্ষকে উপহার দেন এক গোল। ফাহিম, সাদ, সোহেল— তিনজনের ভুলে তিনটি গোল। আর কোচ কাবরেরা? তিনি যেন প্রমাণ করলেন, পরীক্ষার শেষ পাতাটাও ব্যর্থতায় ভরা।
বাংলাদেশ ফুটবলের এই অধ্যায় যেন কাব্যের নয়, কাবরেরার ট্র্যাজেডি। গ্যালারিতে কান্না, মাঠে নিস্তব্ধতা—তবুও কোনো এক কোণে এখনও কেউ হয়তো চুপচাপ বলে উঠছে, “হয়তো আগামীবার…”